Ad Code

Responsive Advertisement

মাত্র ৬ ইঞ্চি কঙ্কাল! এটা কি এলিয়েনের কঙ্কাল নাকি মানুষের?

আজ থেকে প্রায় এগারো বছর আগে, ১৯ শে অক্টোবর ২০০৩ সালে অস্কার মুনজ নামের এক লোক চিলির ‘এটাকামা’ মরুভূমিতে খুঁজে পায় ভীষণ অদ্ভুত একটি জিনিস। সাদা কাপড়ে মোড়ানো ছয় ইঞ্চি লম্বা বল পয়েন্ট কলমের সমান একটি আস্ত কঙ্কাল!  

মাত্র ৬ ইঞ্চি কঙ্কাল! এটা কি এলিয়েনের কঙ্কাল নাকি মানুষের?

কঙ্কালটি দেখতে অবিকল মানুষের মত, তবে মাথাটা দেহের অনুপাতে বেশ বড় এবং সামনের দিকে ঝোঁকা। দেহের সাথে মাথার খুলির অনুপাত মানুষের চেয়ে প্রায় তিনগুন বেশি এবং উপরের দিকে স্ফিত। চোয়ালের হার এবং অক্ষিকোটরের গঠনও বেশ অস্বাভাবিক (সংযুক্ত ছবিগুলো দেখুন)। কঙ্কালটি দেখতে আসলেই অনেকটা কাল্পনিক 'এলিয়েনের' মতোই। মিডিয়ার বদৌলতে চারদিকে খবরটি ছড়িয়ে পড়ল যে এলিয়েনের কঙ্কাল আবিস্কৃত হয়েছে! আর এই তথাকথিত এলিয়েন কঙ্কালটি 'এটাকামা হিউম্যানোইড'(Atacama Humanoid) নামে পরিচিতি পেয়ে গেল। 

মাত্র ৬ ইঞ্চি কঙ্কাল! এটা কি এলিয়েনের কঙ্কাল নাকি মানুষের?

তবে, আসলেই কি কঙ্কালটি এলিয়েনের?

আবিষ্কারের দশ বছর পর কঙ্কালটি উন্মুক্ত করা হয় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। পৃথিবীর বিখ্যাত স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালের একদল বিজ্ঞানী ছয় মাস ধরে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা চালায় এটাকামা কঙ্কালটির উপর। গোটা কঙ্কালটিকে তারা এক্স-রে এবং সিটিস্ক্যান করে। বুকের পাঁজর থেকে হাড় নিয়ে ডিএনএ টেস্ট করে। বিশেষজ্ঞ দল কঙ্কালটির বাহ্যিক অবয়ব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে নিরীক্ষণ করে। বিশেষজ্ঞ দলটির নেতৃত্ব দেন বিশিষ্ট চিকিসক ড. স্টেফেন গ্রীর। মলিকিউলার বায়লোজি এক্সপার্ট প্রফেসর ড. গ্যারি নোলান করেন ডিএনএ এবং জেনেটিক এনালাইসিস, আর রেডিওলোজি এবং অস্থিরোগ বিশেষজ্ঞ ড. লেচম্যান করেন এক্স-রে এবং সিটিস্ক্যান এনালাইসিস। গবেষণার পুরো রিপোর্টি পাওয়া যাবে এই লিঙ্কে।

প্রথমেই বিজ্ঞানীরা যেটা দেখেন সেটা হলো কঙ্কালটি আসল না নকল। তারা বুকের পাজরের অস্থিতে অস্থিমজ্জার প্রমান পান এবং সিটিস্ক্যানে পরিস্কার ভাবে হাড়-এর বৈশিষ্ট্য যাচাই করেন। সিটিস্ক্যানে তারা কঙ্কালটির বক্ষ কোটরে ফুসফুস এবং হৃদপিন্ডও দেখতে পান। তারা বুঝতে পারেন, গোটা প্রাণীটিই কোনো না কোনো ভাবে মমিতে পরিনত হয়েছে। এভাবে, শুরুতেই তারা নিশ্চিত করেন যে কঙ্কালটি নকল নয়, আসল।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল যে কঙ্কালটি হয়ত অপরিণত গর্ভপাতে নষ্ট হওয়া মানব শিশু বা ফিটাস (Aborted foetus) যা কোনো কারণে মমিতে পরিনত হয়েছে; অথবা কঙ্কালটি কোনো শিম্পাঞ্জি বা বানরের; অথবা এলিয়েনেরও হতে পারে! একটা অপরিপূর্ণ মানব শিশু বা ফিটাস এর কঙ্কাল এর দৈর্ঘ্য ছয় ইঞ্চি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

তবে কঙ্কালটির এক্স-রে রিপোর্ট অনুযায়ী ওটা কোনো ফিটাসের কঙ্কাল হতে পারে না। কঙ্কালটির অস্থি এবং অস্থিসন্ধি সম্পূর্ণ ভাবে সুগঠিত এবং পরিপক্ক (Matured), এবং সেই সাথে নিচের পাটিতে দাঁতও রয়েছে! গর্ভাবস্থায় একটা মানব শিশুর হাঁটু (Knee joint) থাকে তরুনাস্থি দিয়ে গঠিত। ভূমিষ্ঠ হওয়ার ৬-৭ বছর পর এই তরুনাস্থি শক্ত (Calcified) অস্থিতে পরিনত হয়। এক্স-রে’তে দেখা এটাকামার হাঠুর গঠন সম্পূর্ণ ভাবে মিলে যায় ৬ থেকে ৮ বছরের মানুষের হাঠুর গঠনের সাথে। অর্থাৎ এটাকামা কোনোভাবেই ফিটাস (গর্ভের শিশু) ছিল না। সে ছিল হেঁটে-চলে বেড়ানো ৬ থেকে ৮ বছরের কোনো মানুষ (অথবা এলিয়েন?) যার উচ্চতা ছিল মাত্র ৬ ইঞ্চি! আর বিজ্ঞানীদের বিস্ময় এখানেই। কেননা, ৬ ইঞ্চি উচ্চতা নিয়ে কোনো মানুষ বাঁচতে পারে না।

তাহলে কি এটাকামা ডোয়ারফিজম (Dwarfism) বা প্রোজেরিয়া (Progeria) সিন্ড্রম জাতীয় কোনো রোগে ভুগছিল? এটাকামার উপরে করা রেডিওলোজির রিপোর্টের ভিত্তিতে এ বিষয়ের এক্সপার্ট ড. লেচম্যান বলেন যে এটাকামার ডোয়ারফিজম অথবা প্রোজেরিয়া সিনড্রমে ভোগার সম্ভবনা নেই বললেই চলে। কেননা, এ সমস্ত রোগে যে আনুষঙ্গিক শরীরক অস্বাভাবিকতা থাকার কথা তা এটাকামার এক্স-রে এবং সিটিস্ক্যানে অনুপস্থিত। উপরন্তু, যে জেনেটিক মিউটেশন এর কারণে এসব রোগ হয়ে থাকে সে ধরনের কোনো জেনেটিক মিউটেশন এটাকামার ডিএনএ বা জিন এনালাইসিস এ পাওয়া যাইনি। এছাড়া চিকিত্সা বিজ্ঞানের ইতিহাসে ডোয়ারফিজম রোগে ভোগা সবচেয়ে ছোটো যে মানুষটির সন্ধান পাওয়া যায় তার উচ্চতা ছিল ১ ফুট ৮ ইঞ্চি। অতএব, সব দিক বিচার করে বিজ্ঞানীগণ মনে করেন এটাকামা হয়ত অন্য কোন জেনেটিক মিউটেশন জনিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

এক্স-রে তে দেখা যায়, এটাকামার পাঁজর এর হাড়ের সংখ্যা মাত্র দশ জোড়া; যেখানে মানুষের থাকে ১২ জোড়া। তবে কিছু বিরল ক্ষেত্রে ১০ বা ১১ জোড়াও থাকতে পারে, কিন্তু সে ক্ষেত্রে অন্যকোন অস্থি বিকৃতি থাকার কথা না। এটাকামার পাঁজরের হাড়ের অস্বাভাবিকতার সাথে রয়েছে মস্তিস্কের হাড়ের অস্বাভাবিকতাও। এটাকামার কপাল থেকে খুলির শীর্ষ পর্যন্ত উচ্চতার অনুপাত একজন মানুষের থেকে ৩ গুন বেশি। এটাকামার হাত পা এবং দেহের অন্যান্য অংশের গঠন স্বাভাবিক মানুষের মত হলেও মস্তিষ্কের গঠন একেবারেই মানুষের সাথে বিসাদৃশ্য! কেন এমন তার উত্তর আপাতত বিজ্ঞানীদের জানা নেই!

এটাকামার অস্থি থেকে স্যাম্পল নিয়ে যে ডিএনএ বা জেনেটিক এনালাইসিস করা হয় তাতে দেখা যায় যে মানুষের সাথে এটাকামার জিনগত অমিল রয়েছে শত করা ৯ ভাগ। যেখানে মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জির জিনগত অমিল মাত্র শতকরা ৩ ভাগ। উপরন্তু, বানর অথবা শিম্পাঞ্জির সাথে এটাকামার জিনগত মিল খুবই কম। দৈহিক এবং জিনগত অমিলের কারণে বিজ্ঞানীগণ একমত পোষণ করেন যে এটাকামা কোনো বানর অথবা শিম্পাঞ্জির কঙ্কাল নয়। আবার বিজ্ঞানীদের হাতে এ যাবত যে তথ্য আছে তাতে করে তারা শতভাগ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না যে এটাকামা একটি ৬ ইঞ্চি উচ্চতার মানব ছিল। তবে যেটুকু নিশ্চিত হয়ে জানা গেছে তা হলো এটাকামা মানব ফিটাস ছিল না; এটাকামা বানর অথবা শিম্পান্জিও ছিল না।

তাহলে কি এটাকামা কোনো নতুন ধরনের মানুষরুপী প্রাণী (New species) ছিল যারা বসবাস করত ১০০ থেকে ১০০০ বছর পূর্বে এই পৃথিবীতেই। যদি তাই হয়, তাহলে তো আরো এটাকামার মত কঙ্কাল পাওয়ার কথা। বিজ্ঞানীরা আসলে এখন তাই খুঁজছে। তারা যদি আরো কয়েকটি এটাকামার মত কঙ্কাল আবিষ্কার করে তাহলে হয়ত উপরের প্রশ্নের উত্তর মিলে যাবে। আর যদি না খুঁজে পায় তাহলে কি ধরে নেয়া হবে যে এটাকামা আসলে ভিন দেশের কোনো এলিয়েনেরই কঙ্কাল? উত্সাহীগণ এটাকামার উপর একটি সুন্দর ভিডিও দেখতে পারেন। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ