Ad Code

Responsive Advertisement

কিংবদন্তী গণিতবিদ - আবূ জাফার মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আল খোয়ারিজমী

আমরা অনেকেই অনেক বিখ্যাত গণিতবিদের নাম শুনেছি, বিশেষ করে জাফর ইকবালের নিউরনে অনুরণন বইয়ের কল্যানে, যেমন কার্ল ফ্রেডরিক গাউস, রামানুজন, পিয়ে দ্য ফার্মা প্রমুখ। আবার অনেকেই মুসলিম চিকিত্সা বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও আল কেমিস্ট ইবনে সীনা, জাবির ইবনে হাইয়ান প্রমুখের কথা জানি। 

কিংবদন্তী গণিতবিদ - আবূ জাফার মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আল খোয়ারিজমী

কিন্তু বিখ্যাত কিংবদন্তী মুসলিম গণিতবিদ আবূ জাফার মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আল খোয়ারিজমী'র নাম অনেকেই শুনিনি, বা শুনলেও তাঁর সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না। না গণিতবিদ হিসাবে, আর না মুসলিম বিজ্ঞানী হিসাবে। আজকের পোস্টে আমি
আবূ জাফার মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আল খোয়ারিজমী'র জীবন ও গনিতে তাঁর অবদান নিয়ে আলোচনা করবো।

প্রথমেই গনিতে মূসার অবদান খানিকটা আন্দাজ করার জন্য কিছু গাণিতিক শব্দের ব্যাখ্যা দেই। এ থেকে আমরা কিঞ্চিত ধারণা করতে পারবো, গণিতের কত বড় উজ্জল এক নক্ষত্র তিনি। এলজেবরা শব্দটি এসেছে দ্বিঘাত সমীকরণ (কোয়াড্রেটিক ইকুয়েশন, যার প্রমিত রূপ ax^2 + bx + c = 0 ) সলভ করার জন্য তাঁর আবিষ্কৃত পদ্ধতি আল জাবর থেকে, যে কারণে তাঁকে এলজেবরা তথা বীজগণিতের জনক বলা হয়। এলগরিদম শব্দটি এসেছে তাঁর নামের ল্যাটিন রূপ এলগরিদমি (আল খোয়ারিজমী > এলগরিদমি) থেকে। স্প্যানিশ গুয়ারিজমো এবং পর্তুগিজ এলগারিজমো শব্দদুটোও (দুটো শব্দেরই অর্থ সংখ্যার একক বা ডিজিট) এসেছে তাঁর নাম থেকেই। 

কিংবদন্তী গণিতবিদ - আবূ জাফার মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আল খোয়ারিজমী

এক নজরে মূসার জীবন:

মূসা আল খোয়ারিজমীর জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তাঁর পুরো নাম ছিলো আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আল খোয়ারিজমী। তিনি জন্ম নেন ৭৮০ সালে, খোরাসানের খোয়ারিজম নামক জায়গায়, তত্কালীন বৃহত্তর ইরানে, বর্তমানের উজবেকিস্তানে। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে জারির আল তাবারী তাঁর নামের শেষে আল মাজুশী যোগ করেন, যা থেকে ধারণা হতে পারে যে তিনি হয়তো প্রাচীন পার্সিয়ান ধর্ম জরথস্ত্রুবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। এটা তত্কালীন পারসিয়ানদের জন্য খুব একটা অসম্ভব ছিলো না, কিন্তু মূসার রচিত বই হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালার মুখবন্ধ থেকে বোঝা যায় যে তিনি একজন ধর্মিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন। মুসলিমগণ ইরান (তত্কালীন পারস্য) জয় করার পর বাগদাদ তদানিন্তন জ্ঞান বিজ্ঞানের কেন্দ্রে পরিণত হয়। অনেক বিজ্ঞানী তখন চীন, ভারত, খোরাসান ইত্যাদি জায়গা থেকে বাগদাদে পাড়ি জমান জ্ঞানের অন্বেষণে। মূসাও ছিলেন তাঁদেরই একজন। তিনি আব্বাসীয় খলিফা আল মামুন (শাসনকাল ৮১৩ – ৮৩৩) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাইতুল হিকমা (হাউজ অফ উইজডম, লাইব্রেরি ও অনুবাদ কেন্দ্র) এর একজন সদস্য পণ্ডিত ছিলেন। তিনি সেখানে প্রধাণ লাইব্রেরিয়ান হিসাবেও কাজ করেছিলেন। এখানে বসেই তিনি বিজ্ঞান ও গণিত চর্চা করতেন এবং এখানে বসেই তিনি গ্রিক ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত অনেক বৈজ্ঞানিক রচনা অনুবাদ করেন। তাঁর মৃত্যু কবে হয়েছিলো তা ঠিক মতো জানা যায়নি। ধারণা করা হয় খলিফা আল মামুনের মৃত্যুর প্রায় ১৪ বছর পর তাঁর মৃত্যু হয়। সে হিসাবে তাঁর মৃত্যু সাল ধরা হয় আনুমানিক ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ।


জ্ঞান বিজ্ঞানে মূসার অবদান:

জ্ঞান বিজ্ঞানের অনেক শাখায়ই (গণিত, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদি) মূসা আল খোয়ারিজমীর অবদান অপরিসীম। বীজগণিত হলো গণিত শাস্ত্রে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান। ৮৩০ সালে তাঁর লেখা বই আল কিতাবুল মুখতাসার ফি হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা (সম্পূর্ণকরণ ও ভারসাম্যকরণের মাধ্যমে গণনার সারসংক্ষেপ) থেকেই এলজেবরার উত্পত্তি। আর এই বইয়ের নাম থেকেই নেয়া হয়েছে এলজেবরা শব্দটিও। ভারতীয়রা প্রথম বীজগণিত নিয়ে গবেষণা করলেও গ্রিকদের মধ্যে ডায়োফ্যান্টাস ছাড়া আর কাউকে বীজগণিত নিয়ে খুব একটা চিন্তাভাবনা করতে দেখা যায়নি। আর ভারতীয়দের গবেষণাও অতি প্রাচীন ছিলো। তাঁদের এই গবেষণাকেও আধুনিকীকরণ করেন মূসা। আজ থেকে প্রায় ২ হাজার বছর আগে ৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় গণিতবিদগণ সর্বপ্রথম সংখ্যা গণনার দশমিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। আর এই পদ্ধতিকে বিশ্বে পরিচিত করে তোলেন মূসা, তাঁর লেখা কিতাবুল জাম ওয়াল তাফরিক ফি হিসাব আল হিন্দ (যোগ বিয়োগের ভারতীয় পদ্ধতি) বইটির মাধ্যমে। গ্রিক গণিতবিদ্যা এবং ইরানি (তত্কালীন পার্সিয়ান) ও ব্যাবিলোনিয়ান জ্যোতির্বিদ্যা নিয়েও তাঁর গবেষণা ছিলো।


আল খোয়ারিজমী টলেমির ভূগোল বিষয়ক গবেষণা নিয়েও কাজ করেন। তিনি তাঁর রচিত কিতাব সুরত আল আরদ (পৃথিবীর মানচিত্র) গ্রন্থে টলেমির ভূগোল বিষয়ক গবেষনার সাহায্যে বিভিন্ন স্থানের কোঅর্ডিনেট নির্ণয় করেন। এ বইয়ে তিনি এশিয়া, আফ্রিকা, ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য ইত্যাদি জায়গার উপর টলেমির দেয়া তথ্য-উপাত্তকে আরো সুসংহত ও নির্ভুল করেন। তিনি এসট্রলেব (সূর্য, চন্দ্র ও গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় ও প্রেডিকশনকারী যন্ত্র) ও সূর্যঘড়ির (সূর্যের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে সময় নির্ণয়কারী ঘড়ি) ওপরও আলোকপাত করেন। তিনি আল মামুনের শাসনামলে পৃথিবীর পরিধি ও মানচিত্র নির্ণয়ের উপর এক প্রোজেক্টে কাজ করেন, যেখানে আরো প্রায় ৭০ জন বিখ্যাত ভূগোলবিদ কাজ করেছিলেন। দ্বাদশ শতকের দিকে তাঁর লেখাগুলো ইংলিশ ও ল্যাটিনে অনুবাদ করা হয়, যা পরবর্তীতে ইউরোপে উচ্চতর গণিতের বিকাশ লাভ করতে প্রভূত সহায়তা করে। ভূগোল ও ত্রিকোণমিতির উপর তাঁর লেখা আরো একটি বই হলো যিজ আল সিন্দ হিন্দ (ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা)। 


আল কিতাবুল মুখতাসার ফি হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালা: 

মূসার লেখা বই হিসাব আল জাবর ওয়াল মুকাবালাকে আধুনিক বীজগণিতের মূলভিত্তি বলে ধরা হয়। আগে মানুষ গণিত বলতে শুধু হিসাব নিকাশ বা পাটিগণিতকেই বুঝতো। এই বই মানুষকে গণিতের আরেক শাখা বীজগণিতের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। রবার্ট আল চেস্টার এই বই আরবি থেকে ল্যাটিনে অনুবাদ করেন ও নাম দেন লিবার আলজেবরেই এত আল মুকাবোলা, যার থেকে এলজেবরা শব্দের উত্পত্তি। ধারণা করা হয় এ বইটি ভারতীয় গণিতবিদ্যা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলো।


মূসা তাঁর এ বইয়ে দ্বিঘাত সমীকরণকে ছয়টি মূল ভাগে ভাগ করেন। এই ভাগগুলো হলো:
১। ax^2 = bx
২। ax^2 = c
৩। bx = c
৪। ax^2 + bx = c
৫। ax^2 + c = bx
৬। bx + c = ax^2

এক্ষেত্রে উল্যেখ্য যে, মুসলিম গণিতবিদগণ নেগেটিভ নাম্বার নিয়ে কাজ করতেন না, আর তাই তাঁদের গবেষনায় সবসময়ই পজিটিভ নাম্বারের আধিক্য দেখা যায়। এ কারণেই ৪, ৫ ও ৬ নং ইকুয়েশনকে এক রকম মনে হলেও তত্কালীন মুসলিম গণিতবিদগণ সেগুলোকে ভিন্ন রকম ধরে গবেষণা করেন, কারণ এই ইকুয়েশনগুলো একই টাইপ ধরতে হলে কোয়েফিশিয়েন্টগুলোকে নেগেটিভ ধরতে হবে।


এই ইকুয়েশনগুলো সলভ করার জন্য তিনি বিখ্যাত দুটি পদ্ধতি দেখান। এগুলো হলো আল জাবর এবং আল মুকাবালা। আল জাবর হলো কোনো ইকুয়েশনের উভয় পাশে সমান ভ্যালুর এলিমেন্ট যোগ করার মাধ্যমে কোনো নেগেটিভ স্কয়ার, রুট বা নাম্বার বাদ দেয়ার পদ্ধতি। মূসার নিজের প্রদত্ত এক উদাহরণ এরকম: x^2 = 40x – 4x^2 ইকুয়েশনের উপর আল জাবর প্রক্রিয়া চালালে পাওয়া যাবে 5x^2 = 40x। বারবার এই প্রক্রিয়ায় কোনো ইকুয়েশন থেকে নেগেটিভ নাম্বারগুলো দূর করা যায়। আল মুকাবালা হলো কোনো ইকুয়েশনের এক পাশ থেকে অপর পাশে একই রকম এলিমেন্টগুলোকে নিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি। যেমন x^2 + 5 = 40x + 4x^2 এর উপর আল মুকাবালা প্রক্রিয়া চালালে পাওয়া যাবে 5 = 40x + 3x^2।


আল খোয়ারিজমী তাঁর বইয়ে এই দুই প্রক্রিয়ার সাহায্যে বীজগাণিতিকভাবে, আবার জ্যামিতিকভাবেও উপরে বর্ণিত ছয় প্রকার ইকুয়েশন সলভ করার পদ্ধতি দেখান। ---

যেমন x^2 + 10x = 39 ইকুয়েশনের সল্যুশন হবে এরকম (মূসার বই থেকে):
কোনো রুটের দশগুণ আর তার স্কয়ার বা বর্গ ৩৯ এর সমান। কাজেই এরকম ইকুয়েশনের সাথে জড়িত প্রশ্নটা এমন: কোন পূর্ণবর্গ সংখ্যার বর্গমূলের দশগুণ আর তার সমষ্টি ৩৯ এর সমান? এরূপ ইকুয়েশন সলভ করার উপায় হলো যতগুলো বর্গমূল দেয়া আছে, তার অর্ধেক নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের এই ইকুয়েশনে বর্গমূলের সংখ্যা ১০। কাজেই ৫ নেবো, এটাকে ৫ দিয়েই গুণ (স্কয়ার) করবো, ফলে পাওয়া যাবে ২৫, যার সাথে ৩৯ যোগ করে পাওয়া যাবে ৬৪। এর বর্গমূল ৮। এবার এই ৮ থেকে বর্গমূলের সংখ্যার অর্ধেক ৫ বিয়োগ করলে পাওয়া যাবে ৩। কাজেই ৩ হলো এই পূর্ণবর্গ সংখ্যার একটা বর্গমূল। কাজেই পূর্ণবর্গ সংখ্যাটি হচ্ছে ৯।  

এই পদ্ধতির জ্যামিতিক প্রমাণ এরকম:
আল খোয়ারিজমী তাঁর জ্যামিতিক প্রমাণে এমন এক বর্গ নিয়ে শুরু করেন, যার এক বাহু x, কাজেই তার ক্ষেত্রফল x^2 নির্দেশ করে (ছবি - ১)। এই বর্গের সাথে 10x যোগ করতে হবে, যা করা হয়েছে এই বর্গের সাথে ১০/৪ প্রস্থ ও x দৈর্ঘ্যের চারটা আয়ত যোগ করে (ছবি - ২)। দ্বিতীয় ছবির পুরো অংশের ক্ষেত্রফল x^2 + 10x, যা ৩৯ এর সমান। এবার তিনি বর্গটি পুরো করেন আরো চারটি ২৫/৪ (৫/২ × ৫/২) ক্ষেত্রফলের বর্গ যোগ করে (ছবি - ৩)। অতএব বড় বর্গের ক্ষেত্রফল হবে ৪ × ২৫/৪ + ৩৯ = ৬৪। কাজেই এই বর্গের বাহুর দৈর্ঘ্য ৮। কিন্তু বড় বর্গের বাহু আসলে ৫/২ + x + ৫/২, কাজেই x + ৫ = ৮ অর্থাৎ x = ৩। ধারণা করা হয়, জ্যামিতিক প্রমাণটির ক্ষেত্রে মূসা ইউক্লিডের এলিমেন্টস এর সাহায্য নেন।


মূসা আল খোয়ারিজমী তাঁর বইয়ে পাটিগনিতের সূত্রগুলো কীভাবে বীজগনিতেও খাটানো যায়, সে ব্যাপারেও আলোচনা করেন। যেমন, (a + bx)(c + dx) কীভাবে গুণ করতে হবে, তা তিনি ব্যাখ্যা করেন। যদিও এই ব্যাখ্যায় তিনি গাণিতিক নোটেশন বা চিহ্নের বদলে শুধু ভাষা ব্যবহার করেন। তিনি তাঁর বইয়ে এসব সমীকরণের প্রয়োগ ও ব্যবহারিক উদাহরণও দেখান। এরপর তিনি বিভিন্ন দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্র যেমন বৃত্তের ক্ষেত্রফল, ত্রিমাত্রিক বস্তু যেমন গোলক, কোণক, পিরামিড ইত্যাদির আয়তন নির্ণয়ের সূত্রাবলী নিয়ে আলোচনা করেন। বইয়ের শেষাংশে তিনি মুসলিম উত্তরাধিকার বিষয়ক আলোচনা করেন।


কিতাবুল জাম ওয়াল তাফরিক ফি হিসাব আল হিন্দ:

পাটিগণিতের উপর লেখা তাঁর এ বইটির মূল আরবি পান্ডুলিপি হারিয়ে যায়, কিন্তু এডিলার্ড অফ বাথ দ্বাদশ শতকে এর যে ল্যাটিন অনুবাদটি করেন, তা অক্ষত থেকে যায়। ধারণা করা হয় তাঁর মূল বইয়ের সাথে এই ল্যাটিন অনুবাদটিরও অনেক পার্থক্য ছিলো। এই অনুবাদটিরও আবার দুটো ভার্সন ছিলো, ১৮৫৭ সালে যাদের নাম দেয়া হয় ডিকসিট এলগরিজমি (আল খোয়ারিজমী বলেছেন) ও এলগরিদমি দ্য নিউমারো ইন্দোরাম (আল খোয়ারিজমীর যোগ বিয়োগের ভারতীয় পদ্ধতি), যার থেকে উত্পত্তি হয়েছে এলগরিদম শব্দের। এই বইয়ে তিনি ভারতীয় গণনাপদ্ধতির উপর আলোচনা করেন। ধারণা করা হয়, এই বইয়ে তিনি হিসাব নিকাশের বিভিন্ন পদ্ধতি যেমন বর্গমূল বের করার উপরও আলোচনা করেন, যদিও তা ল্যাটিন অনুবাদ থেকে হারিয়ে যায়। আরো ধারণা করা হয় তিনিই সংখ্যা পদ্ধতিতে ০ এর গুরুত্ব সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেন।


কিতাব সুরত আল আরদ:

মূসা তাঁর এ বইটি লেখেন ৮৩৩ সালে। এটা আসলে টলেমির ভূগোল বিষয়ক গবেষণার উপর ভিত্তি করে লেখা। এখানে মোট ২৪০২ টি ভৌগলিক স্থানের কোঅর্ডিনেট (অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ) ও অন্যান্য ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ বইটার একটি মাত্র কপি এখনো অক্ষত আছে। মূল বইটির একটি ল্যাটিন অনুবাদও এখনো সংরক্ষিত আছে। আরবি বা ল্যাটিন কোনো ভার্সনেই পৃথিবীর কোনো মানচিত্র পাওয়া না গেলেও, হিউবার্ট ডাউনিক্ট এসব কোঅর্ডিনেট থেকে পৃথিবীর একটি মানচিত্র আঁকতে সক্ষম হন। তিনি বিভিন্ন উপকূলের কোঅর্ডিনেট অনুযায়ী একটি গ্রাফে এসব বিন্দু বসান এবং তাদের একটি সরলরেখা দ্বারা যুক্ত করে উপকূলের একটা সরলরৈখিক এপ্রক্সিমেশন পান। একই কাজ তিনি নদী, শহর ইত্যাদির ক্ষেত্রেও করেন। আল খোয়ারিজমী তাঁর এই বইয়ে টলেমির কিছু ভুল সংশোধন করেন। যেমন, টলেমি ভূমধ্যসাগরের দৈর্ঘ্য মাপতে কিছু ভুল করেন, কারণ দৈর্ঘ্য মাপতে তিনি যে দ্রাঘিমাংশ ব্যবহার করেছিলেন, তা ছিলো ৬৩। কিন্তু প্রকৃত দ্র্ঘিমাংশ আরো কম। মূসা তাঁর বইয়ে এই দ্রাঘিমাংশের মান দেন ৫০, যা আসল মানের অনেক কাছাকাছি। মূসা টলেমির মতের সাথে দ্বিমত পোষণ করে আটলান্টিক আর ভারত মহাসাগরকে উন্মুক্ত জলরাশি বলে মতামত দেন। মূসা তাঁর কোঅর্ডিনেট হিসাবের জন্য প্রাইম মেরিডিয়ান (যার দ্রাঘিমাংশ ০) হিসাবে ভূমধ্যসাগরের পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলের উপর দিয়ে যাওয়া রেখাকে ধরেন। আগে টলেমি তাঁর গবেষণায় প্রাইম মেরিডিয়ান ধরেছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার উপর দিয়ে যাওয়া রেখাকে, যা মূসার হিসাবে অনুযায়ী ১০-১৩ ডিগ্রি পশ্চিমে অবস্থিত ছিলো। বাগদাদের দ্রাঘিমাংশ মূসার গণনা অনুযায়ী, ৭০ ডিগ্রি পূর্বে। পরবর্তীতে অনেক মধ্যযুগীয় ভূগোলবিদ তাঁর এই প্রাইম মেরিডিয়ান অনুযায়ী কাজ করেন।


যিজ আল সিন্দ হিন্দ: 

মূসা আল খোয়ারিজমী এ বইয়ে প্রায় ৩৭ টি চ্যাপ্টারে ক্যালেন্ডার ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক আলোচনা করেন। এ বইটিও ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত। এ বইয়ে তিনি সূর্য, চন্দ্র ও তত্কালীন আবিষ্কৃত পাঁচটি গ্রহের গতিবিধি এবং সূর্যগ্রহণ সম্পর্কে তথ্য ও উপাত্ত সহ আলোচনা করেন। এখানে তিনি সাইন ও ট্যানজেন্ট নিয়েও আলোচনা করেন। এখানে সাইনের বিভিন্ন মান সম্বলিত অনেক ছক ছিলো। এই বইয়ের মূল পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যায়। কিন্তু এটার আরেকটি ভার্সন স্প্যানিশ জ্যোতির্বিদ মাসলামা ইবনে আহমাদ আল মাজরিতি (১০০০ খ্রিস্টাব্দ) কর্তৃক সংরক্ষিত হয়, যা ১১২৬ সালে এডিলার্ড অফ বাথ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন।


মূসা আল খোয়ারিজমীর অন্যান্য কাজ: 

আল খোয়ারিজমীর অন্যান্য কাজের মধ্যে উল্লেখ্যোগ্য হলো ইহুদি ক্যালেন্ডারের উপর তাঁর লেখা বই রিসালা ফি ইসতিখরাজ তারিখ আল ইয়াহুদ (ইহুদি যুগের আদ্যপান্ত)। এখানে তিনি বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার সময় ব্যাখ্যা করেন। এই ক্যালেন্ডারের সাহায্যে তিনি সূর্য ও চন্দ্রের গড় কোঅর্ডিনেটও হিসাব করেন। তিনি পবিত্র শহর মক্কার অবস্থান ও দিক নির্দেশনার উপর কাজ করেন। বার্লিন, তাসখন্দ, প্যারিস, ইস্তাম্বুল, কায়রো ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় অনেক আরবি পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়, যার মধ্যে অনেকগুলোই তাঁর লেখা বলে মনে করা হয়। তাঁর লেখা আরো দুটি বই হলো কিতাব আল রুখামা (সূর্যঘড়ির বই) ও কিতাব আল তারিখ (ইতিহাসের বই), যা কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ